প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে নতুন এক মাইলফলকের সামনে মুশফিকুর রহিম। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি খেলতে যাচ্ছেন শততম টেস্ট। আজ মিরপুরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে মাঠে নামলেই নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে যাবেন তিনি। বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে মাত্র ২৫ বছর আগে। সেই সময় থেকে এখনও ২০০ টেস্টেও পৌঁছায়নি দল। এর মধ্যে মুশফিকের একশ টেস্ট ছোঁয়া বিশেষ এক অর্জন। ২০০৫ সালে লর্ডসে যখন ১৬ বছরের কিশোর হিসেবে মাঠে নামেন মুশফিক। তখন তার সঙ্গে খেলা বেশ কিছু ক্রিকেটার এখন প্রশাসক, কোচ বা খেলাধুলার বাইরে অন্য ভ‚মিকায়। এত লম্বা সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা নিঃসন্দেহে এক অভাবনীয় সাফল্য। বিকেএসপিতে থাকা সময় থেকেই তাকে ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই আস্থার প্রতিদান মুশফিক দিতে শুরু করেন ইংল্যান্ড সফরেই। অত্যন্ত কম বয়সে টেস্ট অভিষেক করানো হলেও কোচ ডেভ হোয়াটমোর তাকে দেখেছিলেন স্পেশাল ক্রিকেটার হিসেবে। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরির পরই লর্ডসে তাকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই সিরিজ ছিল বাংলাদেশ দলের জন্য কঠিন, কিন্তু তরুণ মুশফিকের লড়াই তখন ক্রিকেট বিশ্লেষকদের নজর কাড়ে।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী মুশফিকুর রহিম। দুই দশক ধরে ব্যাট হাতে অদম্য মানসিকতায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে স্থিতিশীল এক উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে। আজ সেই যাত্রায় যুক্ত হতে যাচ্ছে নতুন মাইলফলক। ২০০৭ বিশ্বকাপে কালজয়ী ভারতের বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ফিফটি করে আলোচনায় আসেন তিনি। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে তার দৃঢ় অবস্থান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরিয়নে ডেল স্টেইনের আগুনে বোলিং সামলে দুর্দান্ত ইনিংস খেলে সতীর্থ তামিম ইকবালের চোখে হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটার। ২০০৮ সাল থেকে কোচ জেমি সিডন্স তার ব্যাটিংকে নতুন মাত্রা দেন। গতিময় পিচে পুল, কাট, ব্যাকলিফটসহ বিভিন্ন টেকনিক উন্নত করেন মুশফিক। এর পর থেকেই দেখা দিতে থাকে সেই ধারাবাহিকতা, যেসব শটের জন্য তিনি আজ বেশ পরিচিত। ২৪ বছর বয়সেই বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেয়া হয় তাকে। ২০১৩ সালে গলের মাঠে দেশের প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি করে বদলে দেন দলের ব্যাটিংয়ের মানসিকতা। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায়। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় ছিল তার ব্যাটিংয়ের সেরা ফর্ম। এই সময়ে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি, বহু ফিফটি এবং বিদেশের মাটিতে জয় এনে দেয়া সব ইনিংস দিয়ে প্রমাণ করেছেন তার মানসিক দৃঢ়তা। ২০১৯ সালে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত বদলে দেয় তার ক্যারিয়ার। চাপ কমে যাওয়ায় আরও দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে ব্যাটিং দক্ষতা। গড় বেড়ে ওঠে উল্লেখযোগ্যভাবে। রান আসে নিয়মিত এবং দলের সবচেয়ে ভরসার জায়গা হয়ে ওঠেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দফায় নতুন করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার উদাহরণ হিসেবে মুশফিক আজও সমসাময়িক ক্রিকেটারদের কাছে এক রোল মডেল। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার মনে করেন, মুশফিকের সংযমী জীবনযাপন, নিয়মানুবর্তিতা এবং ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এত দীর্ঘ সময় ধরে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ দলের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের মধ্যে তিনি একমাত্র যিনি এখনো খেলে যাচ্ছেন। সাকিব, তামিম, মাহমুদউল্লাহ ও মাশরাফির আন্তর্জাতিক ছায়া ¤øান হওয়ার পরও দৃঢ়ভাবে টিকে আছেন মুশফিক। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকা সত্তে¡ও প্রতিবার খবর ছড়িয়েছে যে তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন, কিন্তু সব জবাব দিয়েছেন ব্যাট হাতে পারফরম্যান্স দিয়ে। এত দীর্ঘ পথচলার পর একশ টেস্ট শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বড় অধ্যায়। ভীষণ চাপের পরিবেশে, অসংখ্য সমালোচনার মাঝেও দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া এই ক্রিকেটারই এখন দেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান। দুই দশকের ক্রিকেটীয় লড়াই ছাপিয়ে এখন তিনি একজন অনুপ্রেরণা। নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে তার পেশাদারিত্ব, পরিশ্রম আর আত্মনিবেদন। একশ টেস্টের মাইলফলক তার যোগ্য প্রাপ্য। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য তিনি এক সত্যিকারের আয়রন ম্যান। দীর্ঘদিনের সতীর্থ ও বন্ধু তামিম ইকবাল মুশফিকের এই অর্জনকে ‘বিশাল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তামিম বলেন, ‘বাংলাদেশের হয়ে ১০০ টেস্ট খেলার যোগ্যতা যদি কারও থাকে, তবে সে মুশফিক। আমাদের দেশে টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা কম হওয়ায় এই মাইলফলক ছুঁতে তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।’ তামিম আরও যোগ করেন, ‘আমি ১৭-১৮ বছর তার সঙ্গে খেলেছি। অনেককে সেঞ্চুরি করার পর ক্লান্ত হতে দেখেছি, কিন্তু মুশফিককে কখনোই বড় ইনিংসের পর ক্লান্ত হতে দেখিনি। তার রানের ক্ষুধা অবিশ্বাস্য। এই ম্যাচে (আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে) সে ২০ রান করুক বা ২০০, তাকে বিচার না করে কেবল উদযাপন করা উচিত।’ সহযোদ্ধা মমিনুল হক মনে করেন, সেই ইনিংস বাংলাদেশের ব্যাটারদের জন্য ছিল নতুন স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা। মুশফিকের ড্রেসিংরুমের সঙ্গী মুমিনুল হক তার শৃঙ্খলার প্রশংসা করতে গিয়ে মজার ছলে বলেন, ‘মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় তিনি খুব বোরিং জীবন যাপন করেন। একজন মানুষ খেলার প্রতি এতটা নিবেদিত এবং সুশৃঙ্খল (খাবার, ঘুম সব বিষয়ে) কীভাবে হতে পারেন? আমরা কখনোই তার মতো হতে পারব না।’

বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ চন্ডিকা হাতুরুসিংহে মুশফিককে তার দেখা অন্যতম ‘সূ² ও সুশৃঙ্খল’ ক্রিকেটার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য কেবল তাকে পর্যবেক্ষণ করাই একটি শিক্ষা। সে এমন একজন নেতা যে কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। তার প্রস্তুতি বিশ্বমানের। বাংলাদেশ ক্রিকেট তার কারণে সমৃদ্ধ হয়েছে।’ মুশফিকের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের কোচ ডেভ হোয়াটমোর বলেন, ‘মুশফিক জানতো সে কী অর্জন করতে চায়। উত্থান-পতন এবং চোট কাটিয়ে সে যেভাবে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তা দেখে আমি খুব খুশি। সাকিব ও তামিমের পাশাপাশি সেও দেশকে গর্বিত করেছেন। তার ¯øগ-সুইপ শটটি তো কিংবদন্তিতুল্য!’ সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার মুশফিককে ‘মিস্টার ক্রিকেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,‘অন্য বড় দলগুলোর মতো বাংলাদেশ খুব বেশি টেস্ট খেলে না, তাই এত বছর ধরে আগ্রহ ধরে রাখাটাই বিশাল অর্জন। অনেক সময় শরীর বা মন বলে ‘আর না’, কিন্তু মুশফিকের ক্ষেত্রে ‘যথেষ্ট হয়েছে’ শব্দটা নেই। সে আমাদের মিস্টার ক্রিকেট, আমাদের মাইক হাসি। তার এই আবেগই তাকে সবার চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।’