প্রথমবারের মতো আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। গতকাল লর্ডসের ঐতিহাসিক মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে টেস্টের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দলটি। ইতিহাসের পাতায় এবার তাদের নাম উঠে গেল বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। শেষ পর্যন্ত ‘চোকার্স’ তকমা ঘোচাতে পেরেছে প্রোটিয়ারা। ফলে দীর্ঘ ২৭ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আইসিসির বড় কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপার স্বাদ পেল দলটি। এই জয়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবার আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট জিতল। এরআগে তারা জিতেছিল নকআউট ট্রফি (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি)। এরপর বহুবার সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনাল খেলেও হতাশা ছাড়া কিছু জোটেনি। গতকাল চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল মাত্র ৬৯ রান। হাতে ছিল ৮ উইকেট। যদিও ম্যাচের নিয়ন্ত্রণে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। তবে অতীত ইতিহাসের কারণেই অনেকে শঙ্কিত ছিলেন। বিশেষ করে ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিভীষিকাময় ফাইনালের পর। সেদিন বার্বাডোজে ভারতের বিপক্ষে ৩০ বলে ৩০ রান তুলতে ব্যর্থ হয়ে শেষ মুহূর্তে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ ঘটে।
কিন্তু লর্ডসে এমন হতাশার পুনরাবৃত্তি হতে দেননি ফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান এইডেন মার্করাম। গতকাল দিনের শুরুতেই টেম্বা বাভুমা ফিরে গেলেও দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে (১৩৬ রান) দলের জয় নিশ্চিত করেন তিনি। বাভুমার হাফ সেঞ্চুরি ও মার্করামের শতকে ভর করে টেস্টের নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়া ছিল প্রোটিয়াদের হাতে। এর আগে প্রথম ইনিংসে ভালো খেললেও রায়ান রিকেলটন ও উইয়ান মুল্ডার ব্যর্থ হন দ্বিতীয় ইনিংসে। তবে ব্যাটারদের জন্য স্বর্গে পরিণত হওয়া লর্ডসের উইকেটে সেটি আর বড় প্রভাব ফেলেনি। লর্ডসের ঐতিহাসিক মাটিতে চার দিনের ক্লাসিক লড়াইয়ে তারা ৫ উইকেটে হারিয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে। এই ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক এইডেন মারক্রাম। যিনি চাপের মুখে দুর্দান্ত এক ইনিংসে ১৩৬ রান করে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেন। চ্যালেঞ্জিং সিমিং উইকেটে ২৮২ রানের বিশাল লক্ষ্যে নেমে শুরুতেই মাত্র ৬ রানে ওপেনার রায়ান রিকেলটনকে হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে অভিজ্ঞ মারক্রাম এবং তিন নম্বরে নামা উইয়ান মুলডার মিলে শুরুতে ধাক্কা সামাল দেন। তবে তৃতীয় দিনের শেষ ভাগে, মুলডার ২৭ রানে মিচেল স্টার্কের বলে কাভারে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরে গেলে মাঠে আসেন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। এখানেই ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়েও বাভুমা এবং মারক্রাম জুটি গড়েন ১৫৭ রানের জুটি। যা জয়কে অনেকটাই নিশ্চিত করে দেয় প্রোটিয়াদের জন্য। এই জুটিতে মারক্রাম পূর্ণ করেন তার শতক এবং বাভুমা খেলেন সাহসী একটি অর্ধশতক।
তৃতীয় দিন শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ২১২/২Ñজয়ের জন্য বাকি মাত্র ৬০ রান। হাতে ছিল ৮ উইকেট। তবে চতুর্থ দিন শুরুতেই কিছু নাটকীয়তা আসেÑঅজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স বাভুমাকে ৬৬ রানে ফিরিয়ে দেন। আর জশ হ্যাজলউড শেষ মুহূর্তে বিদায় করেন মারক্রামকেও। তবু সেই ক্ষত আর প্রভাব ফেলেনি ম্যাচে। বাকি কাজটুকু সেরে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলে নেয় ক্রিকেট ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত জয়। দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন কাইল ভেরেইনে ও ট্রিস্টান স্টাবসÑতাদের ব্যাটেই পাঁচ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে প্রোটিয়ারা, আর তুলে নেয় ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এর শিরোপা। এই জয়ের পেছনে বড় অবদান রেখে গেছেন কাগিসো রাবাদা, প্রমাণ করেছেন কেন তিনি বিশ্বের সেরা টেস্ট বোলারদের একজন। লর্ডসে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠিয়ে মাত্র ২১২ রানে গুটিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা, রাবাদা তুলে নেন ৫ উইকেটÑএটি ছিল লর্ডসে তার দ্বিতীয় পাঁচ উইকেট নেওয়া এবং ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে কাইল জেমিসনের পর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ফাইফার। তবে অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স দ্বিতীয় ইনিংসে একাই রূপকথা লিখেনÑমাত্র ২৮ রানে ৬ উইকেট, দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুটিয়ে দেন ১৩৮ রানে। বড় লিড নিয়ে অস্ট্রেলিয়া তৃতীয় ইনিংসে বিশাল স্কোরের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু আবারও বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাবাদা ও লুঙ্গি এনগিডির জুটিÑতাদের আঘাতে অজিরা থেমে যায় ২০৭ রানে। দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৮২ রানÑলর্ডসের ইতিহাসে এটি ছিল যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয় পাওয়ার নজির। এমন এক কঠিন মঞ্চে এইডেন মারক্রাম খেলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসÑ১৩৬ রানের সেই মহাকাব্যিক ইনিংসই এনে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার বহু কাক্সিক্ষত আইসিসি শিরোপা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস: ২১২
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ১৩৮
অস্ট্রেলিয়া ২য় ইনিংস: ২০৭
দক্ষিণ আফ্রিকা ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ২৮২) ৮৩.৪ ওভারে ২৮২/৫ (মার্করাম ১৩৬, বাভুমা ৬৬, স্টাবস ৮, বেডিংহ্যাম ২১*, ভেরেইনা ৪*; স্টার্ক ১৪.৪-১-৬৬-৩, হেইজেলউড ১৯-২-৫৮-১, কামিন্স ১৭-০-৫৯-১, লায়ন ২৬-৪-৬৬-০, ওয়েবস্টার ৫-০-১৩-০, হেড ২-০-৮-০)
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ৫ উইকেটে জিতে চ্যাম্পিয়ন
ম্যান অব দা ম্যাচ: এইডেন মার্করাম।