বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম সম্প্রতি ইউটিউবে এক সাক্ষাৎকারে তার প্রতি অসদাচরণের নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। দলের কোচ, ম্যানেজার, ফিজিও, অধিনায়কসহ কয়েকজন ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তোলেন সে। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় দলে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় নিয়েও কথা বলেন। এছাড়া যৌন হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগ তোলেন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করা টাইগ্রেস পেসার। জাহানারা আলম ২০২২ বিশ্বকাপের সময় সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মনজুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি জানান, দলের ক্যাম্প চলাকালীন মঞ্জুরুল প্রায়ই নারী ক্রিকেটারদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতেন। মনজুরুলকে নিয়ে অন্য এক অভিযোগে জাহানারা বলেন, 'বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচে যখন আমরা লাইনে হ্যান্ডশেক করি, তখন তিনি হ্যান্ডশেক না করে জড়িয়ে ধরতেন। যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগ তোলার পর চারদিকে হইচই পরে যায়। বিসিবি রাতেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। যা ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন মনজুরুল। যদিও মঞ্জুরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জাহানারার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বার্তা সংস্থা এএফপিকে বর্তমানে চীনে অবস্থানরত মনজুরুল বলেন, ‘এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। অন্য ক্রিকেটারদের জিজ্ঞেস করুন, আমি ভালো না খারাপ ছিলাম।’ গতকাল জাহানারার সেই অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। গণমাধ্যমকে আসিফ বলেন, ‘আমাদের দপ্তর থেকেও ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি যদি আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, যেহেতু এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’ যৌন হয়রানির ঘটনা ক্রীড়াঙ্গনের জন্য বড় হুমকি বলে মন্তব্য করেন ক্রীড়া উপদেষ্টা, ‘এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। খেলাধুলার অন্যান্য ক্ষেত্রেও বহুবার শুনেছি। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ এ ধরনের কাজ করে পার না পেয়ে যায়।’ জাহানারার অভিযোগের পর এক বিবৃতিতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির পক্ষ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ নারী জাতীয় ক্রিকেট দলের এক সাবেক সদস্যের করা অভিযোগকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বোর্ড। বিবৃতিতে বিসিবি আরও জানায়, বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় অভিযোগের সত্যতা যাচাই ও বিষয়টি গভীরভাবে তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেবে। বিবৃতিতে বিসিবি জানায়, খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের জন্য নিরাপদ, সম্মানজনক এবং পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অভিযোগের তদন্ত শেষে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালীন সময়ে বিসিবি সব পক্ষকেÑ বিশেষ করে গণমাধ্যমকেÑ অনুমাননির্ভর মন্তব্য, প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে করে তদন্ত কার্যক্রমে কোনো ধরনের প্রভাব না পড়ে। বিষয়টি নিয়ে এবার মুখ খুলেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে জাহানারার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তামিম বলেন, ‘জাহানারার অভিযোগগুলো অত্যন্ত গুরুতর। যদি এগুলো সত্য প্রমাণিত হয়, তা কোনোভাবেই সহ্যযোগ্য নয়। শুধু ক্রিকেটার নয়, যে কোনো নারী বা ক্রীড়াবিদ এমন আচরণের শিকার হলে সেটি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য লজ্জার।’ তামিম মনে করেন, বিসিবির অভ্যন্তরীণ তদন্তের পাশাপাশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। তার ভাষায়, ‘বিসিবি একটি কমিটি করেছে ঠিকই, তবে এমন সংবেদনশীল অভিযোগের বিচার বিসিবির বাইরে থেকে হওয়াই উচিত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা সরকারি পর্যায়ে একটি স্বাধীন কমিটি থাকলে পক্ষপাতের সুযোগ থাকবে না।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘জাহানারা এর আগে জাতীয় দলের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন, যা বিসিবি উড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ একজন খেলোয়াড় যখন দলের ভেতরের সমস্যা প্রকাশ করেন, সেটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। যাচাই না করেই মন্তব্য করা কিংবা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক হয়নি।’ নারী ক্রিকেটারদের উদ্দেশে তামিমের আহ্বান, ‘যারা কোনোভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তাদের সাহস নিয়ে সামনে আসা উচিত। আমরা যারা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত, সবাই মিলে পাশে দাঁড়ালে তবেই নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। দেশের ক্রিকেট ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এটা এখন সময়ের দাবি।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এই অভিযোগগুলোর সঠিক তদন্ত না হলে ভবিষ্যতে অনেক মেয়ে খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নিতে ভয় পাবে। আমরা সেটা কোনোভাবেই হতে দিতে পারি না।’