শাহেদ শফিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন সব সময়ই দেশের ছাত্ররাজনীতির একটি বড় ব্যারোমিটার হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে যে ধারা গড়ে ওঠে, তা প্রভাব ফেলে দেশের সার্বিক রাজনীতিতেও। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র শিবিরের ভূমিধস জয় অনেককে অবাক করেছে, আবার অনেকে মনে করছেন দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, সাংগঠনিক দৃঢ়তা আর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের ফলেই এ সাফল্য সম্ভব হয়েছে। অপরদিকে ছাত্রদল এ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের মুখ দেখেছে। জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী এ সংগঠন কীভাবে এ পরাজয়ের মুখে পড়লো সেটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। কারণ ডাকসুর এ নির্বাচনী ফল কেবল সাময়িক কোনো ঘটনা নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্যও একটি বার্তা বহন করছে।

প্রথমেই আসা যাক শিবিরের জয়ের কারণগুলোতে। প্রথমে বলা যায়, তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা। শিবির দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো বজায় রেখেছে। প্রত্যেকটি হলে, প্রত্যেকটি বিভাগের ভেতরে তারা দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে কর্মীদের সক্রিয় রেখেছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিভক্তি দৃশ্যমান হয়নি। ফলে নির্বাচনে তারা একতাবদ্ধভাবে মাঠে নেমে কাজ করতে পেরেছে।

এছাড়া শিবির ছাত্রসমাজের সঙ্গে যোগাযোগের কৌশলও বদলেছে। আগে যেটি কেবল আদর্শগত আহ্বানেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তারা তা বাস্তব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত করছে। শিক্ষার্থীদের হল জীবনের নানা সমস্যা, যেমন আবাসন সংকট, খাবারের মান, সিট বণ্টনের স্বচ্ছতা, এমনকি টিউশন ফি বৃদ্ধি এসব বিষয়ে তারা সরব থেকেছে। এতে সাধারণ ছাত্ররা অন্তত মনে করেছে, তাদের সমস্যার কথা কেউ বলছে। এ বিশ্বাস তৈরি করাই শিবিরকে ভোটারদের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহারেও শিবির এগিয়ে ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। প্রচারপত্র, লিফলেট ছাড়াও নিয়মিত অনলাইন প্রচার তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে। অনলাইনে মতামত গঠন ও তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার এ দক্ষতা প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ছাত্রদলের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। এছাড়া প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শিবির তুলনামূলক ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এমন কিছু প্রার্থী সামনে এনেছে, যাদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা দুর্নীতির অভিযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা আজকাল দলীয় ট্যাগের বাইরে গিয়ে ব্যক্তির চরিত্র ও দক্ষতাকেও মূল্যায়ন করে। শিবির সে বিষয়টি অনুধাবন করেছে এবং যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে।

এছাড়া ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে বেশ কিছু দৃশ্যমান ছাত্রবান্ধব কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। তার মধ্যে হলে হলে বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার স্থাপন, বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলার আয়োজন, পাঠচক্রের আয়োজন, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো, শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করা অন্যতম। অন্যদিকে ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণগুলো স্পষ্ট ও বহুমাত্রিক। সবচেয়ে বড় কারণ হলো দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক দুর্বলতা। নেতৃত্বে বিভাজন, ভেতরে ভেতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এবং মাঠপর্যায়ে কর্মীদের মধ্যে অনীহা—এসব মিলে ছাত্রদল অনেকটা অচল হয়ে পড়েছে। ফলে নির্বাচনী সময়ে তারা সঠিকভাবে সংগঠনকে কাজে লাগাতে পারেনি।

ছাত্রদলের একটি বড় ব্যর্থতা হলো তাদের কমিটমেন্ট শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাছাড়া সাবেক স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য সমমনা দলগুলো এক সঙ্গে আন্দোলন করেছে সে একই ট্যাগিং ছাত্রদলের সমর্থকরা শিবিরের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছে। ছাত্রদল শিবিরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলে প্রচারণা করেছে সেগুলোর সত্যতা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচনে যে সংগঠনের প্রতি আস্থা থাকে না, সে সংগঠন ভোটে সুবিধা করতে পারে না-এ সহজ সত্য ছাত্রদল এড়িয়ে গেছে।

প্রচারণার ক্ষেত্রেও ছাত্রদল ছিল অনেকটা পিছিয়ে। যেটি শিবির দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছে। তাছাড়া ছাত্রদলের নেতাদের মুখে বিভিন্ন সময় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রার্থী নির্বাচন। ছাত্রদল এমন কিছু প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে, যাদের অনেকে চিনেই না, আবার অনেকে চেনে নেতিবাচক কারণে। প্রার্থীর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা নির্বাচনে বিরাট ভূমিকা রাখে। সে বিষয়টি উপেক্ষা করাই ছাত্রদলের জন্য আত্মঘাতী প্রমাণ হয়েছে। এই অক্ষমতা ছাত্রদলের দুর্বলতাকে আরও প্রকট করেছে। ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। টিউশন ফি, আবাসন সমস্যা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা-এসব বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়। তারা বেশি ব্যস্ত থেকেছে জাতীয় রাজনীতির ইস্যুতে, যেখানে সাধারণ ছাত্ররা অনেক সময়ই নিজেদের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায় না। ফলস্বরূপ তাদের কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি।

এ পরাজয় থেকে ছাত্রদলের শেখার অনেক কিছু আছে। প্রথমত, তাদের সাংগঠনিক কাঠামো নতুন করে দাঁড় করাতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে অকৃত্তিম বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। সুসংগঠিত দল গঠন করতে না পারলে ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনী ময়দানে টিকে থাকা কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করতে হবে। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্বেষমূলক রাজনীতি বা বক্তব্য থেকে বেরিয়ে আসার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় আস্থা ফেরাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীবান্ধব দৃশ্যমান পদক্ষেপ বা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তারা যদি শিক্ষার্থীদের সামনে সৎ, মেধাবী এবং যোগ্য নেতৃত্ব হাজির করতে পারে, তবে আস্থা ফিরে পাওয়া সম্ভব। তৃতীয়ত, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অনলাইন প্রচার, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। প্রচারের ধরন ও ভাষা বদলাতে হবে, যাতে তা তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ছাত্রদল তার মূল আদর্শ থেকে এখনো অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে। তাদের অনেকেই জানেই না জিয়াউর রহমানের আদর্শ বা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। দলীয় আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি বৃদ্ধি করতে হবে। আদর্শ থেকে অনেকটা বিচ্যুতির কারণেই সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের দূরে রেখেছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। চতুর্থত, প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে। যাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই, যাদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি কলুষিত, তাদের দিয়ে জয় পাওয়া সম্ভব নয়। সৎ, মেধাবী, পরিচ্ছন্ন ইমেজের ছাত্রনেতাদের সামনে আনতে হবে।

সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা। ডাকসু কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবন ও ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্র। যে সংগঠন তাদের সমস্যার সমাধান করবে, সেই সংগঠনই আস্থা অর্জন করবে। ছাত্রদল যদি সত্যিই নিজেদের পুনর্গঠন করতে চায়, তবে তাদের প্রথম অগ্রাধিকার হতে হবে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো। ডাকসুর নির্বাচনে শিবিরের ভূমিধস জয় শুধু একটি সংগঠনের উত্থান নয়, বরং অন্য সব সংগঠনের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। ছাত্ররাজনীতিতে এখন আর পুরোনো ধাঁচের কৌশল কাজ করছে না। সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে না পারলে যেকোনো সংগঠনই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। ছাত্রদলের আজকের পরাজয় সেই শিক্ষাটিই স্পষ্ট করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকেই উঠে আসে ভবিষ্যতের জাতীয় নেতৃত্ব। ডাকসুর এ নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, শিক্ষার্থীরা এখন সচেতন, তারা শৃঙ্খলাবদ্ধ, দক্ষ এবং প্রাসঙ্গিক নেতৃত্বকে বেছে নিতে চায়। তাই ছাত্রদলের সামনে এখনো সুযোগ আছে—তারা চাইলে নিজেদের সংস্কার করে নতুনভাবে শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারে। কিন্তু তা করতে হলে তাদের কেবল কথাল ঝুলি নয়, বাস্তবেও নিজেদের বদলাতে হবে।

ডাকসু নির্বাচনের পরাজয় যদি ছাত্রদলের চোখ খুলে দেয়, তবে এটি তাদের জন্য আশীর্বাদও হতে পারে। কিন্তু যদি তারা আগের মতোই বিভক্ত, দুর্বল এবং অপ্রাসঙ্গিক থেকে যায়, তবে ভবিষ্যতে তাদের আরও কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। তাই এখনই সময় আত্মসমালোচনার, পুনর্গঠনের এবং শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর।

ডাকসুর নির্বাচনী ফলাফল তাই কেবল একটি সংখ্যার খেলা নয়, বরং ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। শিবিরের জয়ের পেছনে যেমন আছে শৃঙ্খলা, প্রস্তুতি এবং শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের প্রচেষ্টা, তেমনি ছাত্রদলের পরাজয়ের পেছনে আছে অব্যবস্থা, দুর্বলতা এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা। এখন প্রশ্ন হলো, ছাত্রদল কি এ শিক্ষা গ্রহণ করবে, নাকি ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ইতিহাসের কোণে গুটিয়ে যাবে।

সর্বোপরি এ ফলাফল শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ও ছোট দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করবে। এ ভারসাম্য না থাকলে কোনো একটি দলের একচ্ছত্র আধিপত্য গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। অন্যদিকে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিএনপি বর্তমানে দেশের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, এবং পরবর্তী সরকার গঠনে এ দলই মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে অনেকের ধারণা। সে দিক থেকে ডাকসুর এ ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে দুটি প্রধান শক্তির মধ্যে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ধারাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। লন্ডন, যুক্তরাজ্য।