কামরুজ্জামান হিরু : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শুধু রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই নয়, ক্রীড়াঙ্গনেও ঘটে একটি বড় পরিবর্তন। নতুন করে গড়ার প্রত্যয়ে পুরনোকে বিদায় জানায় নতুন সরকার। ভেঙ্গে দেয়া হয় সব ফেডারেশন, বিভাগ ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ের পরিচালনার জন্য প্রথমে সার্চ কমিটি গঠন করে সরকার। ২৯ আগস্ট গঠিত এ কমিটি ছিল নতুনের সন্ধানে।

তবে কমিটির কার্যক্রমে অস্বস্তি তৈরি হয় বিতর্কিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি ও সুপারিশ পরিবর্তনের কারণে। এর পরবর্তীতে আনা হয় এডহক কমিটি, যা আবার অনেকের সমালোচনার মুখে পড়ে। এরমাঝেই ক্রীড়া ফেডারেশন সংখ্যা কমে ৫৫ থেকে ৫২-এ নেমে যায়, যা কিছুটা হতাশাজনক ছিল। ক্রীড়া ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও বছরের শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল মিশ্র ছিল।

ক্রীড়া স্থাপনার নাম পরিবর্তন : ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণে। কয়েক ধাপে বদল হয়েছে ১৯৮টি ক্রীড়া স্থাপনার নাম। যেগুলোর বেশিরভাগই ছিল শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য বা আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে। তালিকায় আছে ৬ ক্রিকেট স্টেডিয়াম, জেলা স্টেডিয়াম ও মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স। বদলে গেছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নামও। ৭১ বছরের পথচলায় ঐতিহাসিক এই ক্রীড়া স্থাপনা ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ হয়ে এখন জাতীয় স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ সংস্কারের পর এ বছর সেই মাঠে ফিরেছে ফুটবল। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বিশেষ সেই মুহূর্ত আরও রাঙ্গিয়ে দিয়েছে ঘরের মাটিতে হামজা চৌধুরী, সোমিত সোম ও ফাহমিদুল ইসলামের অভিষেক। বদলে গেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের নামও। শেখ কামালের নাম বাদ দিয়েছে এনএসসি।

তারুণ্যের উৎসব : যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গৃহীত ‘তারুণ্যের উৎসব’ এক বিশাল পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। ‘এসো দেশ বদলাই, এসো পৃথিবী বদলাই’ ,এই স্লোগানকে সামনে রেখে, গত ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত উৎসবের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এই উৎসবের মাধ্যমে দেশের নানা ক্রীড়া ফেডারেশন প্রতিভা অন্বেষণে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা গেছে, যা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদের সক্রিয় ভূমিকা চিহ্নিত করেছে। ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলা থেকে অসংখ্য নারী খেলোয়াড় উঠে এসেছে, যা দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এক বিশেষ অর্জন।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী,‘তারুণ্যের উৎসব’-এর মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রায় ২ লাখ ৭৪ হাজার নারী ও তরুণী ২ হাজার ৯৩১টি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছেন। এসব ইভেন্টের মধ্যে অন্তত ৮৫৫টি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করা হয়, যেগুলোর মধ্যে কিছু ম্যাচ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনুষ্ঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীদের এত বড় পরিসরে ক্রীড়া ইভেন্টে অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। উৎসবটি শুধু বড়বড় শহরেই নয়, দেশের উপজেলা শহরগুলোতেও ব্যাপক সাড়া ফেলে। সারাদেশে সব মিলিয়ে হয় নারীদের ৫০০ শ’র বেশি ক্রীড়া ইভেন্ট, যা হাজার-হাজার দর্শক উপভোগ করে। উৎসবের প্রাণবন্ত পরিবেশ এই ইভেন্টগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে যে, দ্বিতীয় মেয়াদে এই তারুণ্যের উৎসব এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষনা দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।।

ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারে নতুন কমিটি গঠন : সার্চ কমিটির কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর, ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ক্রীড়াঙ্গনে আরও কার্যকরী সংস্কারের জন্য একটি নতুন কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে, গত ২৪ জুন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একটি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ক্রীড়া-১) সেলিম ফকির, এবং সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) হুমায়ন কবীর। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেনÍ জোবায়েদুর রহমান রানা, আজাদ মজুমদার, ব্যারিস্টার শাইখ মাহাদী, উশু ফেডারেশনের সহ-সভাপতি লে. কর্নেল আবু আইয়ুব মোহাম্মদ হাসান এবং জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জামিল।

এই কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ক্রীড়াঙ্গনে কার্যকরী সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অধিভুক্ত ফেডারেশনগুলোর গঠনতন্ত্র ও অ্যাফিলিয়েশন নীতিমালা যুগপোযোগী করে সুপারিশ প্রদান করা। বিশেষভাবে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব ছিল যা এই কমিটি সংশোধন ও প্রস্তাবনা দেয়ার কাজ করবে।এছাড়া, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চার্টারের আলোকে বাংলাদেশে ক্রীড়া ফেডারেশনের সংখ্যা নির্ধারণ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদানও এই কমিটির কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।

হামজা খুঁজতে সব ফেডারেশনকে এনএসসির চিঠি : বিশ্বের বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ক্রীড়াবিদদের দেশে ফেরানোর উদ্যোগ বেশ কিছু বছর ধরে চলমান। এর মধ্যে আথলেটিক্সে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ইমরানুর রহমান, জিমন্যাস্টিক্সে আমেরিকান প্রবাসী সাইক সিজার, নিউজিল্যান্ডের আলি কাদির, লন্ডনের জুনাইনা আহমেদ এবং ফুটবলে ডেনমার্কের জামাল ভূঁইয়ার মতো নামগুলো পরিচিত। তবে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা ফুটবলার হামজা চৌধুরী। তার আগমন বাংলাদেশের ফুটবলকেই যেন নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছে। হামজার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এখন একের পর এক জাতীয় দলে জায়গা করে নিচ্ছেন ফাহমিদুল, সামিত সোমদের মতো খেলোয়াড়রা।

হামজা চৌধুরীর মতো বিদেশে বসবাসকারী আরও ক্রীড়াবিদদের খুঁজে বের করার লক্ষ্য নিয়ে গত এপ্রিল মাসে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) বিভিন্ন ফেডারেশনে চিঠি পাঠিয়েছে। এই পদক্ষেপটি সরকারের একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৬ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসকে সামনে রেখে জাতীয় দলের জন্য প্রবাসী ক্রীড়াবিদদের সন্ধানে বিভিন্ন ফেডারেশন ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে।

দেশের আট বিভাগে স্পোর্টস হাব স্থাপন:যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দেশের আট বিভাগে স্পোর্টস হাব স্থাপনের পরিকল্পনা জানিয়েছেন, যা ক্রীড়ার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যে নেয়া হচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই প্রকল্পটির কথা তুলে ধরেছেন।এই উদ্যোগের আওতায়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে। ক্রীড়া উপদেষ্টা জানিয়ে দিয়েছেন, আটটি বিভাগের প্রতিটিতে স্পোর্টস হাব গড়ে তোলা হবে, যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আরও শক্তিশালী করবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং তারা স্পোর্টস হাবের জন্য তহবিল সহায়তা দিতে সম্মতি জানিয়েছে।