সংস্কার কমিশনের প্রসেস এবং ইস্যুতে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সকলের কল্যাণ জামায়াতে ইসলামী বিবেচনা করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে সমস্ত ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই একটা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা দরকার। এবং এরপরে যত শিগগিরি সম্ভব নির্বাচন আয়োজন করা দরকার।

গতকাল রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে একথা বলেন তিনি। জামায়াতের নায়েবে আমীর আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, কোনো কোনো ইস্যুতে নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে পাবনা আটঘরিয়া এলাকায় জামায়াতের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এখনও নির্বাচনের তারিখই হয়নি, কিন্তু জায়গা এলাকা দখলের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী নির্বাচনও একেবারে সঠিক ও সুস্থ হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

জাতীয় সনদের ইস্যু নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ ব্যাপারে গণভোট চায়। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, তাতে আইনগতভাবে এর একটা ভিত্তি হবে। এর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে। তিনি জানান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে জামায়াতের পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব দিয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। প্রস্তাব দুটি হলো --- প্রথমত জাস্ট আউট-গোয়িং চিফ জাস্টিস অর্থাৎ সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি আর দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের জন্য একটি সার্চ কমিটি হবে। সার্চ কমিটি কিভাবে গঠন হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা এবং দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি। তিনজন মিলে একজন কেয়ারটেকার চিফ মনোনয়ন করবেন। ইনডিপেন্ডেন্ট জুডিশিয়ারি চাই।

তিনি বলেন আমরা আগে যা জমা দিয়েছিলাম এবার কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। আমাদের চিন্তায় পরিবর্তন এনেছি। জামায়াত ইজ ফর দ্য পিপল বাই দ্য পিপল অফ দ্য পিপল। চিফ এডভাইজার নিয়োগের ব্যাপারে বলেন। আগে এক রকম প্রস্তাবনা ছিল কিন্তু আজ কমিশনের সাথে একমত পোষণ করেছি। ১৬৬ টার মধ্যে ১২৭ জায়গায় একমত হয়েছি। দেশকে চার ভাগ করার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে বলে জানান ডাক্তার তাহের। একটা বিশেষ সময়ে যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে তাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য করার ব্যাপারে একমত হয়েছে বলে মত দেন তিনি।

সংস্কার ইস্যুতে দলের চেয়ে জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত জানিয়ে মো. তাহের বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রসেস এবং ইস্যুতে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে নয় দেশের স্বার্থে জাতীয় স্বার্থে সকলের কল্যাণে জামায়াতে ইসলামী বিবেচনা করছে। এ কারণেই আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যেগুলো উত্তম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সেখানে প্রয়োজনে আমরা আমাদের মত চেঞ্জ করে ঐকমত্য পোষণ করেছি। আমরা যখনই বুঝতে পেরেছি আমাদের যে সিদ্ধান্ত বা চিন্তা তার চেয়ে আরো বেটার হতে পারে দেশ ও জাতির জন্য। তখনই আমরা পরিবর্তন আনছি। কারণ একটাই আমাদের লক্ষ্য কিন্তু দলীয় নয় জাতীয় অর্জন।

তিনি বলেন, গত আলোচনার পর ইতোমধ্যেই দেশে অনেকগুলো ঘটনা ঘটছে। এবং কারো কারো বিবেচনায় বিশ্লেষণ হচ্ছে এর পেছনেও দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র আছে এবং সেই ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে নানামুখী এসব আনরেস্ট তৈরি করার একটি প্রক্রিয়া। আমরা এ ধরনের ষড়যন্ত্রের নিন্দা জ্ঞাপন করছি।

তিনি বলেন, সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, তারা যেন আরো দৃঢ়তা এবং সঠিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। সরকারের সমস্ত পজিটিভ কাজে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

জামায়াতের এ শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, সমস্ত রিফর্ম কমিটির মাধ্যমে আমরা যে বিষয়গুলো বের করে আনার চেষ্টা করছি, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আগামী নির্বাচন। নির্বাচন যেন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সন্ত্রাসমুক্ত হয় এটি আমাদের প্রধান লক্ষ্য। কারণ আজকে বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য সবচেয়ে বেশি অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে গত তিনটি নির্বাচনের নামে প্রহসন। বাংলাদেশকে যদি এথেকে বেরিয়ে আসতে হয়, একেবারে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু অবাধ জাতীয় নির্বাচনই এর সমাধান।

তিনি বলেন, আমরা দেখছি নির্বাচনের ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট একটি তারিখ বা টাইমলাইন না থাকার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরেও নানারকম অস্থিরতা কাজ করছে। এজন্য আমি জাতীয় ঐক্যমুক্ত কমিশনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাতে চাই, আপনারা অনেক পরিশ্রম করছেন সেজন্য ধন্যবাদ। আপনার টানা আলোচনা করে যাচ্ছেন। তবে আমি মনে করি এখানে খুব বেশি সময় না নিয়ে আমাদেরকে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে সমস্ত ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই একটা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা দরকার। এবং এরপরে যত শিগগিরি সম্ভব নির্বাচন আয়োজন করা দরকার।

ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় উপস্থিত নির্বাচন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহের বলেন, আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা করা উচিত যে ব্যবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে সঠিক হবে। এটার জন্য যা যা করা দরকার যদি শক্ত হতে হয় তাহলে শক্ত হতে হবে। কারণ নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠুৃ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কিছুটা প্রশ্নবোধক মনে হচ্ছে উল্লেখ করে তাহের বলেন, কিছু কিছু ঘটনায় নির্বাচন কমিশন সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে পারছে না। সেক্ষেত্রেও সরকারকে অনুরোধ করবো, বিষয়টি যেন খেয়ার রাখা হয়।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠক জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কমিশন সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের নেতৃত্বে দলটির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি (ভারপ্রাপ্ত) এ টি এম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন ও বিশিষ্ট আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

এদিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরির দিকে অগ্রসর হতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ মন্তব্য করেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা দু-একদিনের মধ্যে শেষ করে শীঘ্রই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করবে কমিশন। প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা থাকবে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সেসব বিষয়ে ঐকমত্যের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

অনেক রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, যাদের আত্মদানে এই সুযোগ তৈরি হয়েছে তাদের প্রতি আমাদের দায় আছে। এ দায় শুধুমাত্র জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নয় বরং বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তি, সুশীল সমাজ এবং সামাজিক শক্তিগুলোরও রয়েছে।

এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।