বিশেষ প্রতিনিধি, রাজশাহী: আজ ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ‘মরণ বাঁধ ফারাক্কা’ অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে পদ্মার পানির হিস্যা নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মায় প্রতিবছরই চরের বিস্তৃতি ঘটে চলেছে। এরফলে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে।
মাওলানা ভাসানী ফারাক্কা বাঁধকে বাংলাদেশের জন্য ‘মরণফাঁদ’ বলে ঐতিহাসিক জনসভায় উল্লেখ করেন। লংমার্চের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফারাক্কা রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়। এটি জাতিসংঘ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয় এই ইস্যুকে ভিত্তি করে। এদিকে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে তৎকালীন ভারতীয় শাসকেরা ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হন। উল্লেখ করা যেতে পারে, মাওলানা ভাসানীর সেদিনের লং মার্চ ছিল বাংলাদেশে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লাখো জনতার এক বজ্রনির্ঘোষ প্রতিবাদ। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লং মার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। বেলা ২টায় লাখো মানুষের স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্নবিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লং মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে পৌঁছায়। কলেজ মাঠেই রাত যাপনের পর সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লং মার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী বলেন, ‘বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’
ফারাক্কার কারণে ক্ষতি : প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে বাংলাদেশের গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ১০০ ভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে এবং ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত পাম্প কার্যকারিতা হারিয়েছে। পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি বাড়ায় উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি এখন আর খাবার উপযোগী নয়। উজানের পানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমেছে। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় কৃষিতে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়।
পদ্মার গভীরতা কমেছে : গত ৪০ বছরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। নদীর গভীরতা ১৭.৮ শতাংশ, এবং পানির প্রবাহ ২৬.২ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারিতে পদ্মায় পানি প্রবাহ ছিল ৯০,৭৩০ কিউসেক, যেখানে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে তা নেমে আসে ৭৫,৪০৯ কিউসেকে। এক বছরে পানি প্রবাহ কমেছে ১৫,৩২১ কিউসেক। এই সময় গড় বৃষ্টিপাতও কম ছিল ১৯.২ শতাংশ। পানি সংকটের কারণে নদীর তলদেশ ক্রমেই ভরাট হচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে পদ্মার কিছু মাছ ও প্রাণী যেমন- ডলফিন, ঘড়িয়াল, এবং ইলিশের আগমন এখন অতীত স্মৃতি। জলজ প্রাণীবৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে বিপন্ন। ১৯৭৭ সালে ভারতের সঙ্গে একটি পাঁচ বছর মেয়াদি পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ ৫৫,০০০ কিউসেক হলে বাংলাদেশ পাবে ৩৪,৫০০ কিউসেক। যদি পানির পরিমাণ কমে যায়, তাহলে বাংলাদেশ পাবে কমপক্ষে ২৭,৬০০ কিউসেক, যা ছিল গ্যারান্টি ক্লজ। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেই চুক্তি নবায়নের পরিবর্তে স্বাক্ষর হয় একটি সমঝোতা স্মারক। এতে গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দেওয়া হয়, ফলে বাংলাদেশের অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
একতরফা পানি প্রত্যাহার : ভারত গঙ্গার উজানে একতরফাভাবে প্রায় ৪০০ পয়েন্টে পানি প্রত্যাহার করে। ইতোমধ্যে তারা বাস্তবায়ন করেছে তিনটি প্রধান ক্যানেল প্রকল্প- আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, মধ্য গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট ও নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট। এছাড়া হরিদ্বার থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যে গঙ্গার পানি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভাটির অংশকে প্রায় পানি শূন্য করে ফেলা হয়েছে। সমস্যার সমাধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো- ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রকৃত পানি পাচ্ছে কিনা তা জনগণকে অবহিত করা, ২০২৬ সালের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে চুক্তির পূর্ণ পর্যালোচনা, নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের গ্যারান্টি ক্লজ সংযুক্ত করা, যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করা ও নিয়মিত বৈঠক, ভারত কর্তৃক আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রভাব বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন, আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠন (জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে), ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি, ক্ষতিপূরণ দাবি নিরূপণে বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা।
রাজশাহীতে কর্মসূচি : ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজশাহীতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। লংমার্চ উদযাপন কমিটির উদ্যোগে আজ শুক্রবার বিকেলে রাজশাহী কলেজ অডিটরিয়ামে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মৎস ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। অতিথি থাকবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. সালেহ হাসান নকীব, প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ প্রমুখ। এর আগে একটি র্যালি শহর প্রদক্ষিণ করবে। এ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে একটি রেস্টুরেন্টে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়। এতে ফারাক্কা লং মার্চের ৪৯ বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব সিদ্দিকী বক্তব্য দেন এবং কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান। ফারাক্কা সমস্যাকে শুধু পানি সংকট নয়, বরং একটি আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও ভূরাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখার আহ্বান জানান মাহবুব সিদ্দিকী। তাঁর মতে, “এই সংকট মোকাবিলায় মজবুত জাতীয় ঐক্য, সক্রিয় কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিকল্প নেই।”